রবিবার , ১২ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ২৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
তাবারক হোসেন আজাদ, লক্ষ্মীপুরঃ
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থেকে চাঁদপুরে যাওয়ার পথে আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে চরপাতা বোর্ডারবাজার। তার পাশেই চরমান্দারি নামের নীরব একটি গ্রাম। ওই গ্রামের সড়কের পাশেই কয়েকটি পরিবার মিলে স্ত্রী, দুই ছেলে ও মাকে নিয়েই দিনমজুর মানিকের পরিবারের বসবাস।
প্রতিদিন সকালে দিনমজুর কাজে ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই মানিক শিশু ছেলে খলিলের কপালে চুমু খান। পরে সঙ্গে করে চার বছরের বড় ছেলে শাকিলকে মাদরাসায় পৌঁছে দিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে চলে যান মানিক। কাজ করার সময়ে হঠাৎ বাড়ি থেকে সংবাদ পান খলিল পুকুরে ডুবে মারা গেছে।
ঘটনার ওই শোকাবহ দিনের কথা (৩ জানুয়ারি) বর্ণনা করছিলেন সন্তানহারা পিতা অসহায় দিনমজুর মো. মানিক। এ সময় তার চোখে অশ্রু বেয়ে পড়ছিল।
মারা যাওয়ার আগে বল খেলা করছিল শিশুটি
কিভাবে মারা গেলো শিশুটি জানতে চাইলে তার মা কোহিনুর বেগম বলেন, দেড় বছরের শিশু মো. খলিল। আমাদের দ্বিতীয় সন্তান সে। তার বড় ভাই সোহেল বাবার সঙ্গে মাদরসায় চলে যায়। খলিল আমার সামনেই বল খেলছিল। আমি রান্নার কাজে ব্যাস্ত ছিলাম। তার বাবা সকালেই কাজের সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। চোখের পলকে কখন যে বসতঘরের পাশে খলিল পুকুরে ডুবে যায় তা দেখি নাই।
খোঁজাখুজি করে খলিলকে না পেয়ে চিৎকার করে আমি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটে পড়ি। পরে তার বাবাকে সংবাদ দেই। এ সময় বাড়ির লোকজন আমার চিৎকার শুনে এগিয়ে এসে প্রায় ২৫ মিনিট পর খলিলের মৃত দেহ ভাসতে দেখে পুকুর থেকে দ্রুত উদ্ধার করে রায়পুর সরকারি হাসপাতাল নিয়ে যাই। পরে কর্তব্যরত ডাক্তার আমার খলিলকে মৃত ঘোষণা করেন।
হাপাতালে নেওয়ার ১৫ মিনিটেও ডিউটি ডাক্তার মেলেনি
রায়পুর সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তারা পড়েন বিপাকে। সন্তানের নিথর দেহটি কোলে নিয়ে বসে ছটপট করেন মা।
মা-কহিনুর বলেন, প্রায় ১৫ মিনিট কোনো ডাক্তার ছিলো না। এর পর মহিলা ডাক্তার এসে শিশুকে শুইয়ে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে অবশেষে বলেন, শিশুটি মৃত।
শিশুটির মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া
শিশু খলিলের মৃত্যুতে দিনমজুর অসহায় মা-বাবা ও দাদিসহ পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। বিকালে আসরের নামাজের পর কবরে লাশ দাফন শেষে সবাই চলে যাওয়ার কবরকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘক্ষণ মা-বাবার কান্না দেখে প্রতিবেশিরাও কেঁদেছেন।
চরপাতা ইউপি সদস্য আমিন পাটোয়ারী বলেন, অসহায় দিনমজুর মানিকের শিশু সন্তানের মৃত্যুতে পরিবারের সঙ্গে আমরাও শোকাহত। বিভিন্ন সভার মাধ্যমে পুকুরে পড়া রোধ থেকে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বেশিরভাগ মৃত্যু পুকুরে ডুবে
গত বছরের ৬ মার্চ দুপুরে মা ও ভাই-বোনদের অগোচরে বাড়ির পুকুর ঘাটে খেলা করতে গিয়ে পড়ে ডুবে একসঙ্গে মারা যায় ৩ বছরের ফাইয়াজ ও ৪ বছরের আরিয়া। তারা দুইজনই চট্রগ্রাম আন্দরকিল্লাহ শাহি জামে মসজিদের খতিব আলহ্বাজ মাওলানা আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরির নাতি-নাতনি এবং আলহ্বাজ মাওলানা তাহের ইজ্জুদ্দিনের মেয়ে ও আলহ্বাজ মাওলানা জাহেদ ইজ্জুদিনের ছেলে।
১৪ ডিসেম্বর চরমোহনা ইউপির উত্তর রায়পুর গ্রামের কৃষক রহিমের ছেলে ওয়াহিদুর রহমান রাইমন (২) এবং একইদিন সোনাপুর ইউপির মহাদেবপুর গ্রামের কাশিমের ছেলে আবদুর রহমান (৪) পুকুরে ডুবে মারা যায়।
২০২১ সালের আলোচিত মর্মান্তিক ঘটনা
৩০ অক্টোবর পৌরসভার দেনায়েতপুর এলাকায় নানার বাড়ীতে বেড়াতে এসে দুই বোনের দুই ছেলে শিহাব (১৮ মাস) ও আবদুল্লাহ (২) পানিতে ডুবে মারা যায়।
গত ২৬ জুন চরআবাবিল ইউপির হায়দরগঞ্জের সাইয়্যেদ মঞ্জিলের ভিতরে পুকুরে শিশু ছেলে আরিয়া (৬) ও তার চাচাতো ভাই ফায়সালের ছেলে ফাইয়াজ হোসেন (৭) সাঁতার না জানার কারণে বাড়ির ভেতরে পুকুরে এক সঙ্গে-ডুবে মারা যায়। উপজেলার উত্তর চরবংশী, দক্ষিন চরবংশী, উত্তর চরআবাবিল, দক্ষিন চরআবাবিল, চরমোহনা ও বামনী ইউপিতে বেশি পরিবার শিশুরা পানিতে ডুবে মারা যায়।
এভাবে গত ১৩ মাসে ৫৫ জন শিশু মারা যায় এবং হাসপাতালে ভর্তির পর ১২৭ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, ১৩ মাসে ২২ দিনে পানিতে ডুবে মারা যায় শিশু। ২০২১ সালে পুকুরে ডুবে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১২৩ শিশু। ২০২০ সালে ৪৫ জন মারা যায় ও ভর্তি হয় ১১১ জন শিশু।।
শিশু মৃত্যুরোধে প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা
রায়পুর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার বাহারুল আলম যুগান্তরকে বলেন, মাসে ১০/১৫ পর পরপর আবার সপ্তাহে ২/৩ জন মারা যাওয়া শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসছে। অভিভাবকদের অসচেতনতাই এর জন্য দায়ী। তাদেরকে আরো বেশি সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
রায়পুর এলএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুবুর রহমান সংবাদটুডে.কম কে বলেন, সন্তানকে সাঁতার শেখাতে ব্যক্তি উদ্যোগের কোনও বিকল্প নেই। অভিভাবকের উদাসীনতার কারণে শিশুরা পুকুরে ডুবে মারা যাচ্ছে।